বনমানুষদের মন্তিষ্ক মানুষের মতো ভালো না হলেও পশু জগতে বাকি সকলের চাইতে ভালো। কিন্তু ওরা কেউ কথা বলতে পারে না। হাতিয়ারের মতো ভাষাও একমাত্র মানুষেরই সম্পদ। তার কারণ কিন্তু মানুষদের গলার স্বরযন্ত্রটুকুরই বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ বনমানুষদের প্রয়োজনীয় স্বরযন্ত্র থাকার পরেও প্রকাশ করার মতো তাদের মাথায় কোন ধারণা নেই, কোনো চিন্তা নেই।
কথা বলা মানে আসলে কী? স্বর দিয়ে, শব্দ দিয়ে মরে ধারণা বা মনের চিন্তাকে ফুটিয়ে তুলতে পারা।
চিন্তা ছাড়া ভাষা হয় না।
চিন্তা না করতে পারলে কথা কওয়া যায় না।
কিন্তু ভাষা ছাড়া কি চিন্তা করা যায়? তাও না। এ নিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিকেরা গবেষণা করেছেন। তাঁরা বলছেন, চিন্তা আসলে অনুচ্চারিত ভাষা ছাড়া কিছু নয়। কথা কওয়াই - তবে উচ্চারণ করে নয়, যেন মনে মনে কথা কওয়া, যেন গোপনে কথা কওয়া, যেন নিঃশব্দে কথা কওয়া।
একটু ভাবলেই বুঝতে পারা যাবে। আমি চিন্তা করছি, কলমটা মেরামত করতে হবে। চিন্তাটা ভাষায় বললাম। কিন্তু ভাষা না থাকলে কি চিন্তা করতে পারতাম? ওই ক’টা কথা যদি আমার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়া হতো, যদি আমার মন থেকে সবকটা শব্দ একেবারে মুছে যেত - তাহলে কি আমি ওকথা ভাবতে পারতাম? কথা বাদ দিয়ে ভাববার চেষ্টা করলে দেখা যায় - ফাঁকা। ভাবনা বা চিন্তা বলে কিছুই নেই।
শিশুরা চিন্তা করতে শেখে। কথা কইতে শেখে। একই সঙ্গে। যা-কিছু ভাবে তাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে - উচ্চারণ করে করে চিন্তা করে। এই জন্যেই শিশুদের নিয়ে বড়োরা অনেক সময় মুশকিলে পড়েন। কেননা বড়োরা জানেন, মনের সব কথা সবসময় বলে ফেলা ঠিক নয়। অনেক চিন্তাকে চেপে দিতে হয় - তার মানে মুখ ফুটে বলতে নেই; মনে মনে বলা যায়, নি:শব্দে বলা যায়। বড়োদের কাছ থেকে শিশুরাও ক্রমশ তাই শেখে। তখন মনে হয়, চিন্তা এক, ভাষা আর এক। আসলে তা নয়। চিন্তা ভাষাই। তবে মুখ ফুটে বলা ভাষা নয়।
[দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের পৃথিবীর ইতিহাস থেকে সংকলিত ও ঈষৎ পরিবর্তিত]
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন