৫ ফেব, ২০১০

আত্মনিবেদিত জগদীশ চন্দ্রের পথে

 আমানুল ইসলাম সজীব


জর্জ বার্নাড শ তাকে তৎকালীন জীববিজ্ঞানীদের  মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হিসেবে অভিহিত করেছেন। আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য দান করেছেন তার যে কোনটির জন্য স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা উচিত”। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “অধিকাংশ মানুষেরই যতটুকু গোচর তার বেশী আর ব্যঞ্জনা নেই অর্থাৎ মাটির প্রদীপ দেখা যায়, আলো দেখা যায় না। সে আমার বন্ধু, আমি তার মাঝে আলো দেখেছিলাম।” আলোকিত এই মানুষটির নাম আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। তাঁর জন্মকাল ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ঠিক পরের বছর। দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনের পরও যেসব বঙ্গীয় সন্তান বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে সবসময়ই প্রাধান্য দিয়ে সারা জীবন বিজ্ঞানচর্চায় নিবেদিত ছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম।


আন্তর্জাতিক বেতার বিজ্ঞান সংস্থার অন্তর্গত ৯টি বিভিন্ন কমিশনের ৭টি ক্ষেত্রেই জগদীশ চন্দ্রের অবদান উল্লেখযোগ্য। সামান্য উপকরণকে কাজে লাগিয়ে সূক্ষ কাজের উপযোগী অথচ সরল যন্ত্র নির্মাণে তিনি ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী। মানুষের স্মৃতিশক্তির যান্ত্রিক মডেল তিনিই প্রথম প্রস্তুত করেন।এরপর তিনি বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় উদ্ভিদের সাড়া বিষয়ে গবেষণা করেন এবং এসব গবেষণার জন্য ক্রেস্কোগ্রাফ, স্ফিগমোগ্রাফ, পোটোমিটার, ফোটোসিনথেটিকবাবালার, রেজোনান্ট রেকর্ডার আবিষ্কার করেন।
যদিও সে সময় অর্থ, যন্ত্রপাতি কোনটাই সুলভ ছিলনা। তাঁর কথায় “বিলাতের ন্যায় এ দেশে পরীক্ষাগার নেই, সূক্ষ যন্ত্র নির্মাণও এ দেশে কোনও দিনই হইতে পারেনা, তাহাও কত শুনিয়াছি।তখন মনে হইল, যে ব্যক্তি জৌলুষ হারাইছে, কেবল সেই বৃথা পরিতাপ করে।”


দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের বিজ্ঞানাগারগুলো ঘুরে দেখা গেছে সেগুলোর হতদরিদ্র চেহারা। হাতেগোনা কয়েকটির কথা বাদ দিলে কোথাও সেগুলোকে বিজ্ঞানাগার বলা চলেনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারণটা অর্থনৈতিক, বিজ্ঞানাগারের উপকরণগুলোর বেজায় দাম। তাও আবার সব জায়গায় পাওয়া যায়না। তাই আজ জগদীশচন্দ্র বসুকে বারবার স্মরণ করতে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, পরীক্ষা করার জন্য যন্ত্রপাতি না থাকলে সেটি বানিয়ে নাও। সে কথাকে মনে রেখে মাঠে নামলে হয়ত দেশের হতদরিদ্র বিজ্ঞানাগারগুলোর চেহারা পরিবর্তিত হতে পারে। এর জন্য অর্থের চেয়ে বেশি দরকার স্বপ্ন আর অসম্ভবকে সম্ভব করার মানসিকতা, যেমনটি ছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর। পাশ্চাত্যে ভারতীয় বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা ও স্বীয় বিজ্ঞানের আবিষ্কারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। অদম্য মনোবল, নিষ্ঠা, ধৈর্য্যই তাকে সকল বাধা পেরোতে সহায়তা করেছিল। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু সচেতনভাবে মন্দিরের চিরায়ত ধারণাকে ভেঙ্গেছিলেন।


তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এক বিজ্ঞান মন্দিরের। তার ৫৯ তম জন্মদিনে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। বসু বিজ্ঞান মন্দিরটি ছিল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাগর। যার ভিত্তি বিশ্বাস নয়, প্রতিষ্ঠিত ছিল বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতির উপর যা অজ্ঞতাকে দূরীভূত করে। তাঁর একটি নোটবই ছিল যেটিতে তিনি তরুণ প্রজন্মের জন্য ১১টি মূল্যবান নির্দেশনা লিখে গেছেন। এগুলি হচ্ছে:
১. জীবনের একটা উদ্দেশ্য রাখবে।
২. অসুবিধা দেখলে ঘাবড়ে যাবে না। বাধা আসবে তোমার শক্তি পরীক্ষা করার জন্যে।
৩. সব কিছু তোমার অনুকূলে, তুমি সফল। এ সাফল্যে বাহাদুরি নেই কোনও। বরং বীরের মতো বলÑপারিপার্শ্বিক অবস্থার কোন তোয়াক্কা করি না।
৪. এমন কিছু রচনা কর যা কেউ কখনও করেনি।
৫. জগতের কাছে প্রমাণ কর তার প্রগতিতে তোমারও একটা আবশ্যক ভূমিকা আছে।
৬. এই জগৎ যন্ত্রণারই একটা ধারাবাহিকতা। জেনে রেখ, সর্বত্রই বৈষম্য আর অন্যায় অবিচার।
৭. সর্বহারাদের সঙ্গী হও যেমন মহাত্মা গান্ধী হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। কথা
নয়, অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগেই যত অবিচার দূর করা যায়।
৮. জগতের শক্তির অক্ষয় ভান্ডারে বাগাড়ম্বরে কালক্ষেপ কর না। চিন্তাশীল হও।
৯. চিন্তাকে কাজে পরিণত কর।
১০. যা কিছু করবে, করবে বিরাট হওয়ার সাধনায়। আইনজ্ঞ তো বিশাল আইনজ্ঞ, বিজ্ঞানী তো বিরাট বিজ্ঞানী।
১১. ক্রমাগত চিন্তার মাধ্যমে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নাও।


নির্দেশনাগুলো আমাদের জন্য, তরুণদের জন্য। যাতে তরুণরা আত্মসম্মানবোধ, স্বজাতি ও দেশের প্রতি ভালবাসা থেকে দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।




এই লেখাটি খবর-দার জানুয়ারি 2010 সংখ্যায় প্রকাশিত

0 টি মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন